৩.৩ রক্ত সঞ্চালন

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - হৃদযন্ত্রের যত কথা | NCTB BOOK

এ অধ্যায়ের শুরুতে আমরা জেনেছি যে রক্তসংবহনতন্ত্রের দ্বারা মেরুদণ্ডী প্রাণীদের দেহে রক্ত সঞ্চালন হয়। মানবদেহে রক্ত সংবহনতন্ত্রের প্রধান অংশগুলো হলো: হৃৎপিণ্ড, ধর্মনি, শিরা এবং কৈশিক জালিকা । এগুলোর কাজ সম্পর্কে জানার আগে এগুলোর গঠন সম্পর্কে জানা দরকার, তাই প্রথমে এগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক;

৩.৩.১ হৃৎপিন্ড (Heart)

হৃৎপিন্ড রক্ত সংবহনতন্ত্রের অন্তর্গত একরকমের পাম্প। হৃৎপিন্ড অনবরত সংকুচিত ও প্রসারিত হয়ে সারা দেহে র্য সঞ্চালন ঘটার।মানুষের হৃৎপিন্ড বক্ষগহ্বরে ফুসফুস দুটির মাঝখানে এবং মধ্যচ্ছদার ওপরে অবস্থিত। হৃৎপিন্ডের প্রশস্ত প্রান্ডটি ওপরের দিকে এবং হুঁচালো প্রান্ডটি নিচের দিকে বিন্যস্ত থাকে (চিত্র: ৩.০৮)।হৃৎপিণ্ডটি দ্বিস্তরী পেরিকার্ডিয়াম পর্দা দিয়ে বেষ্টিত থাকে। উভয় স্তরের মাঝে পেরিকার্ডিয়াল ফ্লুইড থাকে, যেটি হৃৎপিণ্ডকে সংকোচনে সাহায্য করে। মানুষের হৃৎপিণ্ড চারটি প্রকোষ্ঠ নিয়ে গঠিত। ওপরের প্রকোষ্ঠ দুটিকে যথাক্রমে ডান এবং বাম অলিন্দ (Atrium) এবং নিচের প্রকোষ্ঠ দুটিকে যথাক্রমে ডান ও বাম নিলয় (Ventricles) বলে। দুটি অলিন্দের ভেতরকার প্রাচীর পাতলা কিন্তু নিলয় দুটির প্রাচীর পুরু এবং পেশিবহুল। ডান অলিন্দের সঙ্গে একটি ঊর্ধ্ব মহাশিরা এবং একটি নিম্ন মহাশিরা যুক্ত থাকে।চিত্র ৩.০৯: ধমনি এবং শিরার প্রস্থচ্ছেদ বাম নিলয়ের সঙ্গে চারটি পালমোনারি শিরা যুক্ত থাকে।

ডান নিলয় থেকে ফুসফুসীয় ধমনি এবং বাম নিলয় থেকে মহাধমনি উৎপত্তি হয়েছে।যেসব রক্তনালির মাধ্যমে রন্তু হৃৎপিণ্ড থেকে দেহের বিভিন্ন অংশে বাহিত হয়, তাকে ধমনি বা আর্টারি বলে। ধমনির প্রাচীর পুরু এবং তিনটি করে গঠিত। এদের গহ্বর ছোট (চিত্র ৩.০৯)। ধমনিতে কোনো কপাটিকা থাকে না। ফলে ধমনি দিয়ে রক্ত বেগে প্রবাহিত হয়।ধমনির স্পন্দন আছে। ধমনি শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয় এবং এদের শাখা ধমনি এবং জার্টোরিওল বলে। এগুলো ক্রমশ শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে অবশেষে সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম কৈশিক জালিকার শেষ হয়। ধমনির মাধ্যমে হৃৎপিণ্ড থেকে দেহের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত পরিবাহিত হয়। তবে ফুসফুসীয় ধমনি এর ব্যতিক্রম, এই রানালি দিয়ে হৃৎপিণ্ড ফুসফুসে রক্ত প্রেরণ করে বলে এটিকে ধমনি (Pulmonary Artery) বলা হলেও এটি কার্বন ডাই-অক্সাইড-যুক্ত রক্ত পরিবহন করে।যেসব রক্তনালির মাধ্যমে কার্বন ডাই- অক্সাইড-পূর্ণ রন্ত দেহের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে হৃৎপিণ্ডে ফিরে আসে, তাদের শিরা বলে। তবে পালমোনারি শিরা এর ব্যতিক্রম। এর মাধ্যমে রক্ত হৃৎপিণ্ডে ফিরে আসে বলে এটিকে শিরা বলা হয়। তবে এই শিল্পা ফুসফুস থেকে অক্সিজেন-সমৃদ্ধ রন্ধধমনি-শিরা হৃৎপিণ্ডে নিয়ে আসে। শিরার প্রাচীর ধমনির মতো ৩টি স্তরে গঠিত হলেও প্রাচীর বেশ পাতলা এবং গহ্বরটি বড় (চিত্র ৩.০১)। শিরায় কপাটিকা থাকায় শিল্পা দিয়ে র ধীরে ধীরে একমুখে প্রবাহিত হয় ।

ডান অলিন্দ→ বাম অলিন্দ ধমনি প্রান্তের কৌশিক জালিকাগুলো ক্রমশ একত্রিত হয়ে প্রথমে সূক্ষ্ম শিরা বা উপশিরা গঠন করে। উপশিরাগুলো পরস্পর মিলিত হয়ে পরে শিরা গঠন করে। কতগুলো শিরা মিলে মহাশিরা গঠন করে। এভাবে শিরা কৈশিক জালিকা থেকে শুরু হয় এবং হৃৎপিন্ডে শেষ হয়।

→ ডান নিলয়

→ বাম নিলয়

চিত্র ৩.১১: হৃৎপিণ্ডের নম্বচ্ছেদ

কৈশিক জালিকা

ধমনি ও শিরার সংযোগস্থলে অবস্থিত কেবল এক স্তরবিশিষ্ট এন্ডোথেলিয়াম দিয়ে গঠিত যেসব সূক্ষ্ম রক্তনালি জালকের আকারে বিন্যস্ত থাকে, সেগুলোকে কৈশিক জালিকা বলে (চিত্র ৩.১০)। কৈশিক জালিকার র্য ও কোষের মধ্যে ব্যাপন প্রক্রিয়ার দ্বারা পুষ্টিদ্রব্য, অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, রেচন পদার্থ ইত্যাদির আদান-প্রদান ঘটে।

৩.৩.২ হৃৎপিণ্ডের কাজ

আমরা পূর্বে জেনেছি, মানুষের রত্না সংবহনতন্ত্র হৃৎপিণ্ড, ধমনি, শিরা এবং কৈশিক জালিকা নিয়ে গঠিত। মানুষের হৃৎপিণ্ড অবিরাম সংকুচিত ও প্রসারিত হয়ে ধমনি ও শিরার মাধ্যমে রক্ত সংবহন করে। হৃৎপিণ্ড পাম্পের মতো নির্দিষ্ট ভালে ও ছন্দে সংকুচিত এবং প্রসারিত হয়ে সারা দেহে রক্ত সঞ্চালন ঘটায় (চিত্র ৩.১১)।

হৃৎপিন্ডের স্বতঃস্ফূর্ত সংকোচনকে সিস্টোল (systole ) এবং শতঃস্ফূর্ত প্রসারণকে ডায়াস্টোল (diastole) বলে। উল্লেখ্য, অলিন্দে যখন সিস্টোল হয়, নিলর তখন ডায়াস্টোল অবস্থায় থাকে।

মানবদেহের রক্ত সংবহন ৩.১২ চিত্রে দেখানো হয়েছে।

হার্ট-বিট

আমরা আগেই বলেছি, হৃৎপিন্ড একটি স্বয়ংক্রিয় পাম্পের মতো দেহের ভিতরে সারাক্ষণ ছন্দের ভালে স্পন্দিত হয়। হৃৎপিণ্ডের এই স্পন্দনকে হৃৎস্পন্দন বা হার্ট-বিট বলে। এই হৃৎস্পন্দনের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ড আমাদের শরীরে সন্তু প্রবাহিত করে।

চিত্ৰ ৩.১২: মানবদেহের বন্ধ সংবহন

হার্ট-বিট বা হৃৎস্পন্দন একটি জটিল বিবর। মানুষের হৃৎপিন্ড মারোেজনিক (myogenic) অর্থাৎ বাইরের কোনো উদ্দীপনা ছাড়া হৃদপেশি নিজে থেকে সংকোচন ও প্রসারণের দ্বারা হৃৎস্পন্দন সৃষ্টি করে। একটি হৃৎস্পন্দন হৃৎপিণ্ডে পর পর সংঘটিত ঘটনার সমষ্টিকে কার্ডিয়াক চক্র বলে। হৃৎপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণের ফলে রুন্তু দেহের ভেতর গতিশীল থাকে। কার্ডিয়াক চক্র চারটি ধাপে (চিত্র ৩.১৩: ক, খ, গ, এবং ঘ) সম্পন্ন হয়:

চিত্র ৩.১৩: কার্ডিরাক চক্র

(ক) অলিদের ডায়াস্টোল: এ সময় অলিন্দ দুটি প্রসারিত অবস্থায় থাকে। ফলে সারা শরীরের CO2 যুক্ত রক্ত ঊর্ধ্ব এবং নিম্ন মহাশিরা দিয়ে ডান অলিন্দে এবং ফুসফুস থেকে O, সমৃদ্ধ রক্ত পালমোনারি শিরা দিয়ে বাম অলিন্দে প্রবেশ করে।

(খ) অলিন্দের সিস্টোল: অলিন্দ দুটি রক্তপূর্ণ হলে এ দুটি সংকুচিত হয়। ডান অলিন্দ থেকে CO, যুক্ত রন্তু ডান নিলয় এবং বাম অলিন্দ থেকে O, সমৃদ্ধ রক্ত বাম নিলয়ে আসে।

(গ) নিলয়ের সিস্টোল: নিলয় দুটি র্যপূর্ণ অবস্থায় সংকুচিত হয়। এ সময় ট্রাইকাসপিড ও বাইকাসপিড কপাটিকা বন্ধ থাকে এবং সেমিনার কপাটিকা খোলা থাকে। নিলয়ের সিস্টোলের সময় কপাটিকাগুলো বন্ধের সময় হৃৎস্পন্দনের প্রথম যে শব্দের সৃষ্টি হয়, তাকে 'লাব' বলে।

এ সময় বাম নিলয় থেকে বিশুদ্ধ রুস্তু (O, যুক্ত রক্ত) মহাধমনি এবং ডান নিলয় থেকে CO, যুক্ত রক্ত ফুসফুসীয় ধমনিতে প্রবেশ করে। মহাধমনি থেকে রক্ত বিভিন্ন ধর্মনি ও শাখা দিয়ে দেহস্থ 

বিভিন্ন জালকে ছড়িয়ে পড়ে এবং কলাকোষকে পুষ্টিদ্রব্য ও অক্সিজেন সরবরাহ করে। অপরপক্ষে ফুসফুসীয় ধমনি থেকে CO, যুক্ত রক্ত ফুসফুসীয় জালকে প্রবেশ করে। ফুসফুস থেকে রক্ত অক্সিজেন গ্রহণ করে ফুসফুসীয় শিল্পা দিয়ে বাম অলিন্দে আসে। অপরপক্ষে সারা দেহস্থ রন্তু জানক থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড-যুক্ত রক্ত (দূষিত রক্ত) উপশিরা, শিরা ও মহাশিরা দিয়ে পুনরায় অলিন্দে ফিরে আসে।

(ঘ) নিলয়ের ডায়াস্টোল: নিলয়ে সিস্টোলের পর পরই নিলয়ের ডায়াস্টোল শুরু হয়। এই সময় আবার অলিন্দ থেকে রক্ত এসে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নিলয় পূর্ণ হতে থাকে। এই সময় এখানকার সেমিনার অলভ বন্ধের সময় যে দ্বিতীয় শব্দের সৃষ্টি হয় তাকে 'ডাব' বলে। 

সুতরাং হৃৎপিণ্ডের শব্দগুলো হলো:

নিলয়ের সিস্টোল = লাব

নিলয়ের ডায়াস্টোল = ভা

একটি সিস্টোল ও একটি ডায়াস্টোলের সমন্বয়ে একটি হৃৎস্পন্দন সম্পন্ন হয় এবং সময় লাগে প্রায় ০.৮ সেকেন্ড। একজন সুস্থ মানুষের হৃৎস্পন্দন প্রতি মিনিটে ৬০-১০০ বার হয়। এটাকে হার্ট-বিট বলা হয়। আমাদের হাতের কবজির রেডিয়াল ধমনিতে এই স্পন্দন গোনা যায় আবার বুকের বাম দিকে নির্দিষ্ট স্থানে স্টেথোস্কোপ বসিয়ে শব্দ শোনা যায়। হাতের কবজিতে হৃৎস্পন্দন অনুভব করাকে পালস বলে। 

স্টেথোস্কোপের সাহায্যে হৃৎস্পন্দনের যে শব্দ শোনা যায়, তাকে হার্টসাউন্ড বলে। হৃৎস্পন্দন বা হার্ট-বিটকে যখন প্রতি মিনিটে হাতের কবজিতে গণনা করা হয়, তখন তাকে পালস রেট

চিত্র ৩.১৪ : নাড়ি বা পালস দেখা

৩.৩.৩ হার্ট-বিট বা পালসরেট গণনার পদ্ধতি

রোগীর হাতের কবজিতে হাতের তিন আঙুল যেমন: অনামিকা, মধ্যমা ও তর্জনি দিয়ে চাপ দিলে হৃৎস্পন্দন প্রতি মিনিটে কতবার হয় তা অনুভব করা যায়। হাতের তিন আঙুল এমনভাবে রাখতে হবে যেন তর্জনি থাকে হৃৎপিণ্ডের দিকে, মধ্যমা মাঝখানে এবং অনামিকা হাতের আঙুলের দিকে (চিত্র ৩.১৪)। মধ্যমা আঙুল দিয়ে বোঝা যাবে হাতের রেডিয়াল ধমনি কত বার ধুকধুক করছে। এক মিনিটে কতোবার স্পন্দিত হচ্ছে, সেটাই হচ্ছে পালস রেট বা পালসের গতি। পালসকে আমরা সাধারণভাবে নাড়ি বলে থাকি।কবজিতে পালস না পাওয়া গেলে কণ্ঠনালির পাশে হৃৎস্পন্দন দেখা যেতে পারে অথবা সরাসরি বুকে কান পেতেও হার্ট সাউন্ড শোনার চেষ্টা করা যেতে পারে। যেকোনো সাধারণ মানুষের পালসের গতি প্রতি মিনিটে কতবার হচ্ছে তা দেখা যায় উপরের বর্ণনা অনুসারে ব্যবস্থা নিলে। ঘড়ি ধরে পালসের গতি দেখতে হয়। সাধারণত পালসের গতি দ্রুত হয় পরিশ্রম করলে, ঘাবড়ে গেলে, ভয় পেলে, তীব্র যন্ত্রণা হলে কিংবা জ্বর হলে। পালসের স্বাভাবিক গতি হলো প্রতি মিনিটে ৬০ থেকে ১০০ বার।

শিশুদের জন্য এটি বেশি প্রতি মিনিটে ১০০ থেকে ১৪০ বার। পূর্ণবয়স্ক মানুষের পালস রেট প্রতি মিনিটে ১০০- এর অধিক হয় জ্বর ও শক্ (অচেতনতা) অথবা থাইরয়েড গ্রন্থির অতি কার্যকারিতার কারণে। ১০ ফারেনহাইট তাপ বৃদ্ধির জন্য পালসের গতি প্রতি মিনিটে ১০ বার করে বাড়ে। পালসের গতি খুব দ্রুত, খুব মন্থর বা অনিয়ন্ত্রিত হলে বুঝতে হবে যে হৃৎপিণ্ডের সমস্যা আছে। প্রতি মিনিটে পালসের গতি ৬০-এর কম হতে পারে হার্ট ব্লকের বা জন্ডিসের কারণে।স্বাভাবিকভাবে মানসিক উত্তেজনা, ব্যায়াম, সন্ধ্যার দিকে পালসের গতি বেড়ে যায়। এ অবস্থায় পালসের গতি অধিক হলেও তা স্বাভাবিক ভাবতে হবে। ঘুমানো অবস্থায় এবং রাতে সুনিদ্রার পর সকালে পালসের গতি ৬০-এর কম হতে পারে। এ অবস্থাটিকেও স্বাভাবিক ধরতে হবে।

 

Content added || updated By
Promotion